কপালের দাগ

Monday, 15th November, 2010

বরফ বাড়ছে।প্রথমে এক ইঞ্চি, দুই ইঞ্চি, তার পর ফুট, ফুট বরফ।কমলা চাঁদের মত রঙের শীতকালের তাপহীন সূর্য। তার আলো পড়েই বরফটাকে যেন আরো বেশি শাদা মনে হচ্ছে।

আমার এত্ত অস্থির লাগছে। কেবলই মনে হচ্ছে একটাই পশমী চাদর দু’জনে মিলে একসাথে গায়ে দিয়ে তোমার কোমর জড়িয়ে, তোমার বুকে নিজেকে সম্পূর্ণ এলিয়ে দিয়ে যদি আজ সারারাত হাঁটি; হয়ত সত্যিই বরফ গলে যেতে পারে। চাঁদের আলোয় প্রেইরী আবার ভেসে যেতে পারে।হয়ত ঘননীল সাটিনের মত ব্লু ট্রি সোওয়ালোগুলো ফিরে এসে আবার বাসাও বাঁধতে পারে। কিংবা সোনালি রঙের ব্ল্যাক সুজান সামনের পুরো সাতাশ একর জমি জুড়ে হঠাৎ ফুটে উঠতে পারে।

এভাবে কিভাবে বাঁচব আমি বলো তো? বেশী কিছু তো চাইনি। শুধু মনে হয় কাচের জানালার উপর বরফের নিঃশ্বাস যখন শক্ত আইসিকল্ হয়ে যায়, তখন যেন পা ছড়িয়ে বসে আছি ঘরের কোণে ঠিক যেখানে দু’টো দেওয়াল এসে মিশেছে ঠিক সেই মাটিতে। তুমিও আমার পাশে আছো। দু’জনে মিলে একটাই যেন কবিতার বই পড়ছি। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে কিংবা জ্বলছে না। তোমার মুখটা তবু শেষ সূর্যের আলোয় কেন যেন কমলা মত দেখাচ্ছে।

আসলে এই স্বপ্নটা কিন্তু এমন কিছু অসাধারণ এবং দুষ্প্রাপ্য কিছু নয়। তবু আমার জীবনে কখনো ঘটবে না বলেই সব সময় কেমন যেন মনে হয় কোনদিন যদি হঠাৎ এমনটা ঘটে যায়, আমি বুঝি ঠিক তখনই মরে যেতে পারব। পৃথিবীতে চাইবার মত আমার আর সত্যি কিচ্ছু থাকবে না!

খুব বুক ব্যাথা করছে। গলার কাছটা ধরে আসছে। আজ আর ডায়েরি লিখতে পারছি না। অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে। তুমি ভালো থেকো। কবিতা লিখো।
~জলরঙ


Tuesday, 16th November, 2010

ধড়ফড় করে ঘামতে, ঘামতে মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে বিছানার উপর উঠে বসেছি। এমন স্বপ্ন কি কখনো কারো দেখা উচিত? সত্যি দেখলাম তুমি বলছ, ‘বাকি জীবন তোমার বাম ঊরুর ওই কালো তিলটাতেই মুখ গুঁজে কাটিয়ে দেব!’

রাতে ঘুমানোর আগে এ্যাডভেয়ার স্টেরোয়েড, ভেন্টোলিন ইনহেলার, লোরাটাডাইন, সিনগুলেয়ার ইত্যাদি, ইত্যাদি এ্যাজমার সব ওষুধ নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। এখন তো আর একটুও নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। কি করব আমি? সারা জীবনে কথা হয়নি তোমার সাথে কোনদিন। দেখা হবে না কখনো। তবু...

সব সময় এত্ত পাগল, পাগল লাগে আমার। দশ আঙ্গুল দিয়ে মাথার দুই পাশের রগ দু’টো চেপে ধরে বাকি জীবন লেপের নীচে মাথা পর্যন্ত ঢেকে, অন্ধকারে শুয়েই কাটিয়ে দেওয়া যেত যদি!

আচ্ছা, ছেলেবেলার গোলাপি-শাদা দোপাটি ফুলের কথা মনে আছে তোমার? আলতো, নরম পাপড়ির নীচে কেমন জন্মদিনের বেলুনের মত গাল ফোলানো থাকতো! ফুলগুলোকে নিয়ে ওই বেলুনগুলো আমরা কপালের ঠিক মধ্যিখানে দুম করে ফোটাতাম। বাজি ফোটার মত শব্দ হ’ত আর কি সুন্দর যে ফুলের জল দিয়ে একটা করে টিপ হয়ে যেত! বড় বেশি ইচ্ছে করছে নিজের সমস্ত অস্তিত্বকে ওই দোপাটি ফুলের মত এক নিঃশ্বাসে শেষ করে, তোমার কপালে সারা জীবনের মত একটা দাগ করে দেই। অনেক চোখের জল দিয়েও কপালের ওই দাগ কিছুতেই আর মুছবে না! কোনদিন!


Wednesday, 17th November, 2010

বাইরে আজও কেবলই বরফ পড়ছে। আর আমি ঠান্ডা কাচের জানালার পাশে বসে সে রাতের অবিশ্রান্ত বৃষ্টির কথা ভাবছি। ভাবছি শাদা প্রজাপতির মত দেখতে দোলনচাঁপা ফুল, দিনের আলো নিভে যাওয়ার একটু আগের ওই রঙধনু আর ভীষণ জ্বরে পুড়ে যাওয়া তোমার গরম শরীরের কথা। মোমের আলোতে দেওয়ালের উপর কেঁপে কেঁপে ওঠা নিজের কথাও ভাবছি, অল্প।

শাদা বরফ আমার সামনে পড়ে আছে সত্যিকারের জীবনের মত। যা কিছু আসলে মানুষের জীবনে ঘটে কিংবা ঘটতে পারে তার মত। সারাদিন এত শাদা দেখতে, দেখতে রঙধনুর রঙগুলোকে এত বেশী দূরের অবাস্তব গল্প বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনভাবেই অত রঙ মানুষের চোখ আসলে সহ্য করতে পারে না।হয়ত সে জন্যই মানুষের চোখে ঠাকুর পলক দিয়েছে। বারবার ভুল ভাঙ্গাতে চোখের পলক ফেলতে থাকলে মানুষের স্বপ্নগুলোও হাঁটতে শুরু করে।চোখ থেকে হেঁটে, হেঁটে তারা সবাই মাথার খুলির ভিতর ঢুকে পড়ে। খুলির ভিতর কোনভাবে একবার ঢুকে পড়তে পারলে পাল্কি চেপেও লাল রঙের নতুন বউ হয়ে স্বপ্নরা আর কোথাও যেতে পারে না। ওরা শুধু আগুনের ফুলকি হয়ে, জোনাক পোকার মত তারপর থেকে জ্বলতে থাকে। সারাটাক্ষণ এক অনন্ত হাহাকারের মত।

খুলির চারপাশে শাদা হাড়ের কবর। মানুষের মাথার শাদা হাড় হাতুড়ি দিয়েও তো গুঁড়িয়ে ফেলা যায় না। চিতার আগুনে সব পুড়িয়ে মানুষ তাই শেষ অস্তিত্বে নারকোলের মালসার মত কপালের একটা হাড় হয়েই বেঁচে থাকে। তুলসীতলায় প্রদীপের তেল পড়ে সেই একাকী হাড় যতবার আলো পায়, হাড়ের গায়ে লেপ্টে লেগে থাকা স্বপ্নগুলো ঠিক ততবার সরীসৃপের মত নিঃশ্বাস ফেলে।

আর তাই মানুষের স্বপ্ন মানুষের জীবনের থেকে অমর।আর মানুষের জীবন তার স্বপ্নের থেকে পুরানো। এবং স্বপ্ন, জীবন এই সবকিছুই টিনের একটা ভাঙ্গা ট্রাঙ্কে, ন্যাপথলিন দিয়ে জমিয়ে রাখা ছেঁড়া কাঁথা আর লাল শালু লেপের শাদা মার্কিনের ওয়্যারের মত। অনেক শীতের পরও তার পরের শীতে ঠিক আবার দিব্যি ব্যবহার করা চলে। শুধু একদিন ভোরবেলা থেকে সন্ধ্যাবেলা বারান্দায় রোদ লাগালেই হয়ে যায়। কিংবা একটা দু’টো শুধু এদিক ওদিক তালি। সাথে সাথেই সব স্বপ্ন আর সব জীবন শীত দুপুরে পা ছড়িয়ে খাওয়া কমলালেবুর মত চনমনে হয়ে ওঠে। খোসার নীচে শাদা রঙের মাংসের চামড়া উপচিয়ে সোনালি।

Thursday, 18th November, 2010

সেই কোন সন্ধ্যারাত থেকে শেষরাত শ্মশান ঘাট থেকে নদীর বাতাস বেয়ে পোড়া মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে।

আগুনে দাউ, দাউ পুড়ে যাচ্ছে শরীর। শুধু পুড়ছে না কপালের ওই হাড়। আর সেই হাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা সেইসব স্বপ্নের ধ্বংসস্তুপ। হাড়ের গায়ে লেপ্টে স্বপ্নগুলো কি অদ্ভুতভাবে দিব্যি বেঁচে থাকছে, ঠিক যেভাবে বেঁচে থাকে অনেক প্রেমে জড়িয়ে থাকা মানুষ আর তার মানুষীর শরীর। প্রেম মরে না কোনদিন...স্বপ্ন মরে না।

শুধু মহেঞ্জোদারোর পাথর হয়ে যাওয়া ভেঙ্গে পড়া কাদামাটির জানালার ফাঁক গলে একসময় সব ভৌতিক স্বপ্ন আর সব ভৌতিক প্রেম তোমাকে দখল করে ফেলে।আমাকে দখল করে ফেলে। কবরের ভিতর আঙ্গুলে আঙ্গুল জড়িয়ে চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কোথাও পালানোর পথ থাকে না।

আজ কোথায় যাবে তুমি? শেষবারের মত? এই অবেলায়?

Comments

Popular Posts